«

»

জানু. 05

টেকনিক্যাল রিপোর্ট রাইটিং – লেকচার ৩ – রেজুমি (Resume) ও সিভি (CV) – পর্ব ১

 রেজুমি (Resume) ও সিভি (CV)- পর্ব ১


রেজুমি ও কারিকুলাম ভিটা (সিভি) খুব পরিচিত দুটি শব্দ সবার কাছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনাকে রেজুমি বা সিভি লিখতে হতে পারে। সেটা চাকুরীর জন্যে আবেদনই হোক কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্যেই হোক, এমনকি বিয়ে করতে গেলেও পাত্র বা পাত্রীর অভিভাবক চেয়ে বসতে পারে এই ডকুমেন্টটি। রেজুমি ও সিভি মূলত আপনার পরিচয়, যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রাপ্তি, ইচ্ছা, ইত্যাদির সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট।
গুরুত্বপূর্ণ – আপনার রেজুমি বা সিভিকে অবশ্যই নিয়মিত আপডেট করবেন।

রেজুমি ও সিভির মধ্যে পার্থক্য কি?

রেজুমি ও সিভির মূল অংশগুলো একই রকমের।
রেজুমি মূলত এক বা দুই পৃষ্ঠায় লেখা হয়। রেজুমি যেহেতু আকারে ছোট, তাই ভিন্ন ভিন্ন চাকুরীর আবেদনে আপনার রেজুমিটিও হতে পারে ভিন্ন। কারন, আপনাকে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অন্যদিকে সিভি লেখায় পৃষ্ঠার সীমাবদ্ধতা নেই এবং স্বাভাবিকভাবেই বিবরনগুলোও হয় তুলনামূলক বিস্তারিত, এমনকি এখানে কয়েকজন সম্মানিত ব্যাক্তির নাম-ঠিকানা (রেফারেন্স) উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সাধারণত, মধ্যম বা উচ্চস্তরের চাকুরি (ক্যারিয়ার) অথবা ফেলোশীপের জন্য কাজে লাগে। তার মানে রেজুমি ও সিভির প্রধান পার্থক্য এর আকারে এবং প্রাসঙ্গিকতায়।
এই কোর্সটা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা এন্ট্রী লেভেল চাকুরীজীবীদের জন্যে যাদের অধিকাংশের রেজুমি আর সিভি আলাদা আলাদাভাবে করার প্রয়োজন পড়েনা, তাই রেজুমি আর সিভির পার্থক্য নিয়ে আর কথা না বাড়াই। বরং আমরা রেজুমি লেখা শুরু করি।

রেজুমিতে যা যা থাকবেঃ

১. আপনার ব্যাক্তিগত তথ্য (নাম, ঠিকানা, ই-মেইল এড্রেস, টেলিফোন নম্বর)। ব্যাক্তিগত তথ্য সবসময় প্রথম পৃষ্ঠার উপরে থাকবে। ই-মেইল এড্রেস বিষয়ে একটা ব্যাপার যোগ করতে চাই, তাহলো অফিসিয়াল রিপোর্টে আপত্তিকর বা হাস্যকর ই-মেইল আইডি ব্যাবহার করবেন না। কভার লেটারে তারিখ লিখতে হয় কিন্তু রেজুমিতে দিতে হয়না।
২. আপনার উদ্দেশ্য (চাকুরীর বিজ্ঞাপন দেখে নিজেরমত লিখে নিতে পারেন)।
৩. শিক্ষাগত যোগ্যতা।
৪. প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতা (কাজের ইতিহাস নয়)
৫. টেকনিকাল স্কিল (কম্পিউটার স্কিল, বিশেষ মেশিন অপারেটিং ইত্যাদি)।
৬. ইন্টার্নশীপ (যদি করে থাকেন)
৭. পাবলিকেশন (যদি কোন প্রাসঙ্গিক ও মোলিক প্রকাশনা থাকে)
৮. বৃত্তি বা পুরস্কার(যদি পেয়ে থাকেন)
৯. ভাষার দক্ষতা
১০. আগ্রহ ও শখ (রেজুমিতে এর প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে)
১১. রেফারেন্স (অপ্রয়োজনীয়)

 

I উদ্দেশ্যঃ কোন ধরনের জব প্রত্যাশা করেন তাই এক বা দুটি বাক্যে লিখবেন। (অপশনাল).
II ব্যাক্তিত্ত্ব ও যোগ্যতার বিবরনঃ এই ব্যাপারটা অপশনাল। ইচ্ছে হলে বাদ দিতে পারেন। যদি কারো বিশেষ কোন গুণ, দক্ষতা বা ইতিবাচক বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা আবেদনকৃত চাকুরিতে অবদান রাখার মতো, সেটা লিখতে পারেন। আসলে নতুন গ্রাজুয়েট যাদের রেজুমি একপৃষ্ঠা ভরে লিখতেই খবর হয়ে যায়, তারা এই অপশনটা যোগ করতে পারেন। ধরা যাক, আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং সেকশনে কাজ করতে চান এবং আপনার ভাল কমিউনিকেশন স্কিল আছে, ভাল টিম-ওয়ার্ক স্পিরিট আছে ইত্যাদি, সেটাই লিখবেন। তবে, অহেতুক কথা না লেখাই ভাল। প্রয়োজনে বাদ দিন।
III. শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ উল্টো ক্রমানুযায়ী লিখবেন। মানে বড় থেকে ছোট। মাস্টার্স আগে, ব্যাচেলর পরে। এই ক্রমটাই বেশি চলে।
Master of Science in Major, University Name, City, Country, Month Year, GPA: 3.9 out of 4.0
Øআপনার স্পেলাইজেশন উল্লেখ করুন। এক বা দুই বাক্যে।
Øরিসার্চ প্রজেক্ট/ থিসিসের শিরোনাম উল্লেখ করুন।
Bachelor of Science in Major, University Name, City, Country, Month Year, GPA: 3.9 out of 4.0
Øমাইনর বিষয় (যদি থাকে)উল্লেখ করুন।
Øরিসার্চ প্রজেক্ট/ থিসিসের শিরোনাম (যদি থাকে) উল্লেখ করুন।
Øবিশেষায়িত বিষয়গুলো উল্লেখ করুন।
*ডিগ্রীর সিজিপিএ/রেজাল্ট দূর্দান্ত না হলে উল্লেখ না করাই ভাল।
*সাধারণত, প্রযোজ্যক্ষেত্র ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের কথা উল্লেখ করা হয়না।
IV. ইন্টার্নশীপঃ কোন প্রতিষ্ঠানে (লোকেশন সহ) এবং কতদিন (সময়কাল) কাজ করেছেন। বিশেষ প্রশিক্ষন থাকলে তা উল্লেখ করতে পারেন।
V. বৃত্তিপ্রাপ্তি/পুরস্কারঃ যদি থাকে যোগ করুন। বৃত্তি বা পুরস্কারের নাম (কবে, কেন সহ)। কিন্ডারগার্টেনে পড়াকালে টিউটোরিয়ালে প্রথম হয়ে যে দুটো চকলেট পেয়েছিলেন সেটা গোপন করুন।
VI. প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতাঃ প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতা (পার্ট-টাইম বা ফুল-টাইম, স্বেচ্ছাসেবা) উল্লেখ করুন। কোথায় (অবস্থান), কোন পদে এবং কতদিন কাজ করেছেন। সদ্য পাশ করা আবেদনকারীদের অভিজ্ঞতা কম থাকায় সাধারণত শিক্ষাগত যোগ্যতা আগে দিয়ে থাকে, কাজের অভিজ্ঞতা তারপর দিয়ে থাকে।
VII. প্রকাশনাঃ যদি কোন প্রাসঙ্গিক ও মোলিক প্রকাশনা থাকে। অপ্রাসঙ্গিক হলে বাদ দিন।
VIII. বিশেষস্কিল এবং সার্টিফিকেশনঃ যদি কোন টেকনিকাল স্কিল, কম্পিউটার স্কিল, প্রোগ্রামিং বা সার্টিফিকেশন থাকে, সেগুলো উল্লেখ করুন। এই ধরনের স্কিল অথবা সার্টিফিকেশন বহু ক্ষেত্রে একই সিজিপিএ পাওয়া আপনার ক্লাসমেটের থেকে আপনাকে আলাদা করে দিতে পারে।
IX. ভাষার দক্ষতাঃ আপনার ভাষার দক্ষতা(দক্ষতার স্তরসহ) লিখুন। কিছু বাংলাদেশি এই জায়গাটাতে হিন্দি বা উর্দুর কথাও লিখে, আমি ব্যাক্তিগতভাবে এটা অপছন্দ করি ।
X. পেশাদারী সদস্যপদঃ উল্লেখ করুন যদি প্রাসঙ্গিক হয়। এই ব্যাপারটাকে আমাদের দেশে খুব একটা উৎসাহ না দিলেও প্রফেশনাল মেম্বারশীপের গুরুত্ত্ব আছে। কারন, অনেক পেশাদারী সংগঠনগুলো নিয়মিত বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার, কনফারেন্স ইত্যাদি আয়োজন করে এবং তরুনদের প্রশিক্ষন ও উৎসাহ দিয়ে থাকে যা তাদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। অবশ্য, প্রাসঙ্গিক না হলে বর্জনীয়।
XI. ব্যক্তিগত শখ বা ইচ্ছাঃ তিন/চারটি উল্লেখ করতে পারেন (অপশনাল)। রেজুমিতে এর প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে।
•রেফারেন্স আছে লাগলে আওয়াজ দেন (References available upon request)।  এই বাক্যটি কেউ কেউ যোগ করে থাকেন। ব্যাপারটা অহেতুক।

টিপসঃ

  • জন্মস্থান, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি নিতান্ত ব্যাক্তিগত তথ্য কোনভাবেই রেজুমির অংশ হতে পারেনা।
  • অহেতুক কারনে রেজুমিতে অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে চাকুরীদাতার ধৈয্য পরীক্ষা না করাই উত্তম।
  • নিজে এবং অন্য কাউকে দিয়ে বার বার প্রুফ দেখুন।
  • ফন্ট এবং ফন্টের আকার (১০ বা ১২) সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
  • মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিবেন না।
  • বক্স বা কলাম বা টেবল দিবেন না।
  • রেজুমি লেখা আর রচনা লেখা এক নয়।
  • রেজুমিতে ফটো লাগাবেন না (যদি স্পষ্ট করে দিতে না বলে)।
  • এক রেজুমি দিয়ে জীবন পার নয়। চাকুরীর বিজ্ঞাপন পড়ে প্রস্তুত করুন।
  • সর্বনাম পদ বাদ দিন।
  • অহেতুক সাজ-সজ্জা বাদ দিন।
  • কারো রেজুমির টেমপ্লেট নকল করবেন না। নিজেরটা নিজেই করুন।

রেজুমির সাধারণ প্রকারভেদঃ

কালানুক্রমিক রেজুমি (Chronological Resume): সাধারণত মধ্যম বা উচ্চপদের জন্য আবেদনে এই ধরনের রেজুমি ব্যাবহার করা হয় এবং আবেদনকারীর প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যথেষ্ট ধারাবাহিক কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
প্রায়োগিক রেজুমি (Functional Resume): যাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা কম বা ক্যারিয়ারে কিছু কিছু বিরতি আছে তারা এই ধরনের রেজুমি ব্যাবহার করেন যেখানে একটা সাধারণ ধারনা থাকে বটে কিন্তু কর্মক্ষেত্রগুলোর বিশদ বিবরন থাকেনা।
মিশ্র রেজুমি (Combination Resume): সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার করা হয় এই ধরনের রেজুমি যা দুই ধরনের রেজুমির মিশ্রন করে লেখা হয়। আমি মনে করি, এন্ট্রী-লেভেল বা মিড-লেভেল চাকুরীপ্রার্থীদের জন্যে এটাই উপযুক্ত।
(চলবে)
(এই পোস্টের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্টে সেটা লিখুন)

Comments

comments

About the author

বিলাস আহমেদ খাঁন

আমি খুব মাঝারি গোছের মানুষ। স্কুল-কলেজে কোনদিন ফার্স্ট হইনি, ফেলও করিনি। আমার মেধা কম, কিন্তু হতাশাবাদী নই। আমি বিশ্বাস করি, স্বপ্ন এবং চেষ্টা খুব কম মেধার মানুষকেও অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। আমি জানি, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আমার মতো যারা ক্লাসরুমে পেছনের বেঞ্চে বসেই স্বস্তি পায়, অধিকাংশ শিক্ষকই তাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। কোন দরকারে শিক্ষকদের কাছে গেলে শুনতে হয় "তুমি আমাদের ছাত্র? কোনদিন তো দেখিনি!" আমি ওইসব শিক্ষার্থীদেরকে বলতে চাই "হতাশ হয়ো না। দুনিয়াতে খুব বেশি মানুষ প্রকৃতির উপহার নিয়ে মেধাবী হয় না। বেশির ভাগ মানুষই তোমার-আমার মতো। অল্প মেধা নিয়েও সততা, ধৈর্য্য, চেষ্টা আর স্বপ্ন দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া যায়।"

পরিচিতিঃ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত কলেজ অব টেক্সটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বি এস সি করেছি, এরপর দক্ষিন কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওসিনথেটিক্স নিয়ে গবেষণার চেষ্টা করেছি। ইনহা থেকে মাস্টার্স ও পি এইচ ডি-শেষ করেছি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ডে বসে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।

Leave a Reply