«

»

জানু. 28

জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) – লেকচার ৫

[নিবন্ধনের লিংক | কোর্সের মূল পাতা]

[জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) – লেকচার ৪]

[জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) – লেকচার ৬]

অভিক্ষিপ্ত স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা

গত পর্বে (লেকচার ৪) আমরা ‘ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা’ (Geographic Coordinate System) সম্পর্কে জেনেছি। আজকে আমরা ‘অভিক্ষিপ্ত স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা’ (Projected Coordinate System) নিয়ে জানতে চেষ্টা করব।

ভূমিকাঃ

মানচিত্র অভিক্ষেপ (Map Projection) হল ভৌগলিক অবস্থানের (অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ) বর্তুল (ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠ) থেকে পরিকল্পক (দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ) স্থানাঙ্কে নিয়মানুগ (গাণিতিক) রূপান্তর। সহজ কথায়, মানচিত্র অভিক্ষেপ হল পৃথিবীর বাঁকা পৃষ্ঠকে (curved surface) মানচিত্রে সমতল পৃষ্ঠতলে (flat surface) উপস্থাপন করার একটি উপায়।

বাস্তব বর্তুল (spherical) বিশ্বের কোন কিছুর অবস্থান কৌণিক দূরত্বের (অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ) মাধ্যমে বর্ণিত হয়। কিন্তু সমতল মানচিত্রে কোন কিছুর অবস্থান কার্তেসীয় স্থানাংক ব্যবস্থার (‘X’ এবং ‘Y’) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় (নিচের ছবিটি দেখুন)।

কোন কিছুর অবস্থান নির্ণয় করার জন্য, ‘ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা’ একটি ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠতল ব্যবহার করে এবং ‘অভিক্ষিপ্ত স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা’ একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠতল ব্যবহার করে।

এখন সমস্যা হল, এই অনিয়মিত আকৃতির ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর পৃষ্ঠকে একটি সমতল ও দ্বিমাত্রিক কাগজের টুকরায় (Map) স্থানান্তর করা। নানাবিধ গাণিতিক ও জ্যামিতিক উপায়ে, মানচিত্র অভিক্ষেপ, এই রূপান্তর করা হয়ে থাকে। কিন্তু জেনে রাখা ভাল যে, কোনরূপ বিকৃতি (Distortion) ব্যতীত এই রুপান্তর সম্ভব নয়। প্রতিটি অভিক্ষেপ (Projection)-এর নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধাসমূহ আছে।

প্রতিটি সমতল মানচিত্রই কোন না কোনভাবে ভূপৃষ্ঠের ভুল বর্ণনা দিয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত এমন কোন মানচিত্র অঙ্কিত/ আবিষ্কৃত হয়নি, যা সমগ্র পৃথিবীকে ১০০% সঠিকভাবে উপস্থাপিত করে।

কেন এই বিকৃতি?

উপরের ছবিটিতে বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানসমূহ দেখা যাচ্ছে। এইখানে কেন্দ্রিয় (central) এলাকা যদিও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু প্রান্তিক এলাকাসমূহ (edges shapes) বিকৃতরূপে দৃশ্যমান।

আবার নিচের ছবিটিতে ‘এন্টার্কটিকা’ এবং ‘অস্ট্রেলিয়া’ দেখা যাচ্ছে ভিন্নভাবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একই স্থান বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং অবস্থান (Angle & Position) থেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়।

মৌলিক অভিক্ষেপণ প্রযুক্তিঃ

সহজ কথায়, মানচিত্র অভিক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থাকে (অক্ষাংশ ‘φ’ এবং দ্রাঘিমাংশ ‘λ’) কার্তেসীয় স্থানাংক ব্যবস্থায় (‘x’ এবং ‘y’) রুপান্তর করব। এখন আসা যাক, এই মানচিত্র অভিক্ষেপ কিভাবে করা হয়?

খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, প্রথমে এই পদ্ধতিতে একটি কল্পিত কাগজের টুকরাকে (যা পরবর্তীতে একটি মানচিত্রে পরিণত হবে) পৃথিবী পৃষ্ঠে অধিশায়িত (laid) করা হয় (নিচের ছবিটি দেখুন)।

এখন এই কল্পিত কাগজের টুকরাটি (Map Plane/ Developable Surface) ভূপৃষ্ঠের যেখানে স্পর্শ করবে, সেইখানে বিকৃতি (Distortion) হবে শূন্য এবং দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকৃতিও বৃদ্ধি পাবে (নিচের ছবিটি দেখুন)। এরপর কিছু প্রতিষ্ঠিত গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে [(x, y) = f (φ, λ)] এই রুপান্তর করা হয়।

মানচিত্র অভিক্ষেপণের শ্রেণীবিভাগঃ

মানচিত্র অভিক্ষেপ নিম্নলিখিত ৪টি উপায়ে শ্রেণীবিন্যাস করা যায়ঃ

১. Developable Surface:

এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মানচিত্র অভিক্ষেপণের মাধ্যমে মানচিত্র প্রস্তুতকরণের তিনটি মৌলিক পদ্ধতি আছে। এগুলো হল (নিচের ছবি তিনটি দেখুন):

  • Azimuthal/ Planar: এক্ষেত্রে কল্পিত কাগজের টুকরাটি হয় ‘সমতল’ আকৃতির।
  • Conical: এক্ষেত্রে কল্পিত কাগজের টুকরাটি হয় ‘মোচাকৃতি’।
  • Cylindrical: এক্ষেত্রে কল্পিত কাগজের টুকরাটি হয় ‘বেলনাকার’।

এই ক্ষেত্রে একটা কথা জেনে রাখা ভাল। কাল্পনিক এই তল (Developable Surface) পৃথিবীর যেখানে স্পর্শ  করে, ঠিক সেখানকার অক্ষাংশকে- ‘Standard Parallel’ এবং দ্রাঘিমাংশকে- ‘Central Meridian’ বলা হয় (নিচের ছবিটি দেখুন)।

২. Point of Contact:

এইখানে দুই ধরণের শ্রেণী (Class) আছে।

১. Tangent তল

এই শ্রেণীর ‘Developable’ তলটি; ‘Azimuthal’-এর ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের একটি মাত্র বিন্দুকে স্পর্শ করে (Touch), আর ‘Conical’ এবং ‘Cylindrical’-এর ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের একটি রেখাকে স্পর্শ করে (নিচের ছবিটি দেখুন)।

২. Secant তল

এই শ্রেণীর ‘Developable’ তলটি; ‘Azimuthal’-এর ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠকে একটি রেখা দ্বারা ছেদ করে (Intersect), আর ‘Conical’ এবং ‘Cylindrical’-এর ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠকে দুইটি রেখা দ্বারা আড়াআড়িভাবে ছেদ করে (নিচের ছবিটি দেখুন)।

৩. অভিক্ষেপ সমতলের অভিমুখঃ

ভূগোলকের সাপেক্ষে অভিক্ষেপ সমতলের (Projection Plane’s) অভিমুখ (Orientation) বিবেচনা করে তিন ধরণের শ্রেণীবিভাগ হতে পারেঃ

  • Normal: এই ক্ষেত্রে অভিক্ষেপ সমতলের অভিমুখ পৃথিবীর অক্ষের সমান্তরালে (Parallel) থাকে।
  • Transverse: এই ক্ষেত্রে অভিক্ষেপ সমতলের অভিমুখ পৃথিবীর অক্ষের সাথে সমকোণে (Perpendicular) থাকে।
  • Oblique: সকল ধরণের অসমান্তরাল এবং তির্যক অভিমুখসম্পন্ন তল এই ধরণের শ্রেণীর অধীনে।

৪. বিকৃতির বৈশিষ্ট্যঃ

আমরা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছি যে মানচিত্র অভিক্ষেপণের ফলে বিকৃতি ঘটবেই। এখন প্রশ্ন হল মূল বাঁকানো ভূগোলকের সাপেক্ষে কি ধরণের হবে এই বিকৃতি? মানচিত্র অভিক্ষেপণের ফলে সাধারণত নিম্নলিখিত ৪ টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিকৃতি (Distortion) হয়ঃ

  • অভিমুখ (Direction)
  • দূরত্ব (Distance)
  • আকার-আকৃতি (Shape)
  • আয়তন/ ক্ষেত্র (Size/ Area)।

বিকৃতির এই বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে চার ধরণের উপশ্রেণী হতে পারেঃ

  • Azimuthal: ইহা একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রিয় বিন্দু (Central Point) থেকে অন্য কোন বিন্দুর অভিমুখ (Direction) সঠিকভাবে প্রদর্শন করে।
  • Conformal: ইহার প্রতিটি বিন্দুতে কোণ (Angle) সংরক্ষিত থাকে।
  • Equal-Area: এই অভিক্ষেপ কোন কিছুর (feature) ক্ষেত্র/ আয়তন ঠিক রাখে।
  • Equidistant: ইহা দুইটি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যকার দূরত্ব অক্ষুণ্ণ রাখে।

সঠিক মানচিত্র অভিক্ষেপ নির্বাচনঃ

যে কোন ধরণের মানচিত্র তৈরির প্রথম শর্ত হল, একটি যথাযথ মানচিত্র অভিক্ষেপ (map projection) এবং এর পরামিতিসমূহ (parameters) নির্ধারণ করা। এই কাজ একজন মানচিত্রকার (Cartographer) করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে কোন একটি নির্দিষ্ট/ বিশেষ এলাকার জন্য যথাযথ মানচিত্র অভিক্ষেপ বাছাই করা সম্ভব? ইহা নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যেতে পারে:

১. এলাকার আকার/আকৃতিঃ

অভিক্ষেপের ধরণ কি হবে তা নির্ভর করে ঐ নিদিষ্ট এলাকার আকৃতির (Shape) উপর। ‘Cylindrical’ অভিক্ষেপ সাধারণত আয়তক্ষেত্রাকার (Rectangular) এলাকার জন্য, ‘Conic’ অভিক্ষেপ ত্রিকোণী (Triangular) এলাকা এবং ‘Azimuthal’ অভিক্ষেপ গোলাকার (Circular) এলাকার জন্য ব্যবহৃত হয় (নিচের ছবিটি দেখুন)।

২. এলাকার অবস্থানঃ

নির্দিষ্ট এলাকার অবস্থান (Location) এবং অভিযোজন (Orientation)-এর উপর নির্ভর করেও সঠিক মানচিত্র অভিক্ষেপ নির্ণয় করা হয়। সবচেয়ে উত্তম অবস্থা হল, যখন অভিক্ষেপ কেন্দ্র (Projection Centre) ঐ নির্দিষ্ট এলাকার কেন্দ্রের সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে (Coincide) থাকে।

উপরের ছবিটি যদি আমরা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পারি যে, একটি ‘Oblique Cylinder’ অভিক্ষেপের কেন্দ্র আমাদের প্রত্যাশিত নির্দিষ্ট এলাকার কেন্দ্রের সাথে মিলে যাচ্ছে। তাই এই নির্দিষ্ট এলাকার মানচিত্র তৈরির জন্য ‘Oblique Cylinder’ অভিক্ষেপ বাছাই করা যৌক্তিক হয়েছে।

৩. মানচিত্রের উদ্দেশ্যঃ

অভিক্ষেপ নির্বাচনের সর্বশেষ নির্ণায়ক হল মানচিত্রের মূল উদ্দেশ্য। এই পর্যায়ে এসে আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে যে আমরা আসলে কোন ধরণের বিকৃতি (Distortion) সম্পন্ন মানচিত্র চায়। আমরা কি একটি মানচিত্রের নির্দিষ্ট এলাকার অভিমুখ (Direction) ঠিক রাখতে চাই, নাকি আয়তন (Area) ঠিক রাখতে চাই নাকি আকৃতি (Shape) ঠিক রাখতে চাই? এর উপর ভিত্তি করে মানচিত্র প্রস্তুত করতে হবে। নিচের ছবিটিতে বিভিন্ন অভিক্ষেপে পৃথিবীর অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

উপসংহারঃ

মানচিত্রের সঠিক এবং নিখুঁত অভিক্ষেপ বলে কিছু নাই, একজন মানচিত্রকার তাঁর চাহিদা মত সেরা অভিক্ষেপটি পছন্দ করেন। সর্বোপরি মানচিত্র প্রস্তুতকারকদেরকে জাতীয় নিয়মাবলী (National Convention) বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত।

‘অভিক্ষিপ্ত স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রথম পর্বের আলোচনা আজকের মত এইখানেই শেষ হল। এরপর দ্বিতীয় পর্বে আমরা আরও বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করব। ধন্যবাদ!

 

Comments

comments

About the author

বায়েস আহমেদ

বায়েস আহমেদ বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের 'Commonwealth Scholarship' নিয়ে 'University College London (UCL)'-এ 'PhD' অধ্যয়ন করছেন। বর্তমানে উনার গবেষণার বিষয় হল - বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধ্বস এবং সংশ্লিষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা।

এর আগে উনি ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে বুয়েটের ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা’ বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর উনি ২০১১ সালের মার্চ মাসে ‘European Commission’-এর ‘Erasmus Mundus’ বৃত্তি নিয়ে ইউরোপের জার্মানি, স্পেন ও পর্তুগাল থেকে ‘Geospatial Technologies’-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

‘GIS’, ‘Remote Sensing’ এবং ‘Spatial Analysis’ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সাময়িকীতে উনার একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘GIS’-এর প্রশিক্ষক হিসাবেও উনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।

Leave a Reply