«

»

জানু. 01

দাবা খেলা পরিচিতি – লেকচার ৯.১ ঃ খেলার প্রারম্ভিক ভাগের দশটা নিয়ম

আমাদের এই লেকচারের উদ্দেশ্য হলো খেলার শুরুর দিক – ওপেনিং বা প্রারম্ভিক ভাগ পরিচালনা করতে শেখা। ওপেনিং শেখার জন্য আমরা দশ টা সাধারণ নিয়ম শিখবো।
ইউটিউব ভিডিও লিঙ্কঃ

বিকল্প লিঙ্কঃ

lesson9.1.opening principles from Pingo Penguin on Vimeo.

১/ সমস্ত ঘুটি বাইরে আনুন (develop your pieces)

খেলার শুরুতে সমস্ত ঘুটি প্রথম সারিতে থাকে। সামনে বোড়ের বাধা। বোড়ের বাধা সরিয়ে সমস্ত্ ঘুটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাইরে আনুন। খেলায় জিততে গেলে সমস্ত ঘুটিকে একসাথে ব্যবহার করা শিখতে হবে। সমস্ত ঘুটি বাইরে না আসা অবধি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকুন। নতুন খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তারা সমস্ত ঘুটিকে একসাথে ব্যবহার করতে জানে না, অল্প সংখ্যক ঘুটি -১ টা বা ২ টো ঘুটি নিয়ে – প্রতিপক্ষকে আক্রমনের চেষ্টা করে। অনেক সময় প্রতিপক্ষ খারাপ খেলোয়াড় হলে এরকম আক্রমণ সামলাতে না পেরে সহজে পরাজিত হয়, তবে সব সময় খেলার ফল দিয়ে খেলার চাল বিচার করার ধারনা ভুল।

সাধারণত কোন একটা খেলায় বিজয়ী খেলোয়াড় এর সমস্ত চাল ভালো চাল হয়না, এবং পরাজিত খেলোয়াড় এর সমস্ত চাল খারাপ চাল হয়না। একটা সাধারণ খেলায় ভালো খারাপ মাঝারি সমস্ত রকমের চাল মিলে মিশে থাকে। এই কথাটা যে আজকে এইমাত্র খেলা শিখেছে থেকে শুরু করে বিশ্বচাম্পিয়ন এর খেলা – সব খেলার জন্যই সত্যি।

যুদ্ধ প্রস্তুতির আগে একটা বা দুটো ঘুটি দিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা (premature attack) একটা প্রচন্ড বাজে অভ্যাস। এই অভ্যাস কাটিয়ে না ওঠা অবধি আপনার খেলায় উন্নতির সম্ভাবনা কম। কারন আপনি ভুল জিনিস অভ্যাস করে চলেছেন। এরকম ভাবে খেলা নতুন খেলোয়াড়দের বিপক্ষে দু একবার সফল হওয়া সম্ভব, তবে একটু ভালো খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে সাধারণত সফল হবেন না, কারন এরকম আক্রমণ প্রতিহত করা একজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের পক্ষে খুব একটা কঠিন নয়। বিফল আক্রমনের পিছনে চাল দিতে সময় নষ্ট হয়। সেই সময় ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ সমস্ত ঘুটি বাইরে এনে ভালো অবস্থায় পৌছে যায়, এবং খুব সহজেই খেলার রাশ নিয়ন্ত্রণ করে, এবং সাধারণত সহজে জয়ী হয়।

২/ সমস্ত ঘুটি বাইরে আনুন (develop your pieces)

সুতরাং দ্বিতীয় নিয়ম টাও প্রথম  নিয়মটার মতোই। আরও ঘুটি বাইরে আনুন। সমস্ত ঘুটি বাইরে আনুন। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত ঘুটি বাইরে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই নিয়ম টা আবার স্মরণ করুন। যতদিন অবধি না এই নিয়ম টা জল/পানি খাবার মত অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে ততদিন ধরে এই নিয়মটা মেনে খেলা পরিচালনা করার চেষ্টা করুন। আমি ঘুটির বিকাশের কথা বারবার বলছি কারন এর চেয়ে দরকারি আরও কোনও নিয়ম নেই। সুতরাং ঘুটির বিকাশের কোনও বিকল্প নেই।

ঘুটি বাইরে ভালো জায়গায় এসে গেলে তাকে ডেভেলপড বা বিকশিত ঘুটি বলা চলে। একটা ঘুটি কে বিকশিত করতে যতটা সম্ভব কম চাল ব্যয় করুন। অর্থাৎ একটা চালে দুটো ঘুটির বিকাশ সম্ভব হলে তা একটা ঘুটির বিকাশের চেয়ে ভালো চাল হবে, এরকম। ঘুটির বিকাশ বলতে আমি বোড়ে বাদ দিয়ে অন্য ঘুটি বোঝাচ্ছি। বাংলায় ঘুটি শব্দ টা বেশ গোলমেলে। ইংরিজিতে বোড়ে কে pawns বোড়ে ছাড়া বাকি সমস্ত ঘুটিকে সংক্ষেপে pieces বলে।

বোড়ের চালের পিছনে যতটা সম্ভব কম সময় নষ্ট করুন। মাথায় রাখবেন বোড়ের চালে কোন ঘুটির বিকাশ হয়না, তাই অনর্থম বোড়ের চাল দেওয়া মানে অহেতুক সময় নষ্ট করা। অহেতুক সময় নষ্ট করা খারাপ। শুধুমাত্র অন্য ঘুটির বিকাশের পথ তৈরীর জন্য বোড়ের চাল চালুন। খেলার শুরুতে মাত্র একটা বা দুটো বোড়ে চালের মাধ্যমে সমস্ত ঘুটির চালের জন্য লাইন তৈরী করার চেষ্টা করুন।

৩/ সমস্ত ঘুটি বাইরে আনুন (develop your pieces)

সুতরাং তৃতীয় নিয়মটাও প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়মটার মতোই। তার কারন ডেভেলপমেন্ট প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ। খেলার শুরুতে ঘুটির বিকাশ এর পিছনে সমস্ত চিন্তাভাবনা ব্যয় করুন।

আমরা এতক্ষণে জেনেছি ঘুটির বিকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং খুব বেশী সংখ্যক বোড়ের চাল ঘুটির বিকাশে সাহায্য করে না। সুতরাং বোড়ে বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত ঘুটির বিকাশে জোর দেওয়া উচিত। ছোটো ঘুটি মানে ঘোড়া ও গজ, আর বড় ঘুটি মানে নৌকা ও মন্ত্রী।  কিন্তু কোন ঘুটির বিকাশ সবার আগে ভালো?

এর উত্তর সহজ। সবার আগে ছোটো ঘুটির বিকাশের মাধ্যমে খেলা শুরু করুন। সবার আগে ঘোড়া ও গজ বাইরে আনার চেষ্টা করুন। সাধারণত প্রথমে ঘোড়া তারপর গজ বাইরে আনা ভালো, কারন খেলার শুরুতে ঘোড়ার চালের জন্য কম সংখ্যক ভালো ঘর থাকে, সেই তুলনায় গজ এর চালের জন্য একধিক ভালো ঘরের সম্ভাবনা থাকে। তাই আগে ভালো ঘরে ঘোড়ার চাল দেবার পর সুযোগ বুঝে সবচেয়ে ভালো ঘরে গজের চাল দেওয়া ভালো।

একটা আদর্শ ঘুটি বিকাশের উদাহরণ

৪/ খেলার শুরুতে একটা ঘুটি একবার এর বেশি চালবেন না

আগের তিনটি নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই নিয়মটা বানানো। ঘুটি বিকাশের সময় আপনাকে যত সম্ভব কম সময় ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে। তাই প্রত্যেকটা চালের পিছনেই একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। উদ্দেশ্যহীন চাল কখনও ভালো হতে পারে না। সম্ভব হলে একটা চালের মাধ্যমে একটার বেশি উদ্দেশ্য পূরণ করার চেষ্টা করুন। যেমন একটা চালের মাধ্যমে দুটো ঘুটির বিকাশ সম্ভব হলে তা একটা ঘুটির বিকাশের চেয়ে ভালো চাল, ইত্যাদি।

এতক্ষণে আমরা নিশ্চয় বুঝেছি যে একটা ঘুটি অকারণে একবারের বেশি চালা মানে অহেতুক সময় নষ্ট। ওই চালটি হয়তো অন্য কোন ভালো কাজে ব্যবহার করা যেতো। তাই খেলার শুরুতে বিশেষ দরকার ছাড়া একটা ঘুটিকে একবারের বেশি চালবেন না। সমস্ত ঘুটি বাইরে না আসা অবধি এই নিয়মটা মেনে চলুন, আপনার পক্ষে খেলা পরিচালনা করা অনেক সহজ হবে।

অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে এই নিয়ম এর ব্যতিক্রম আছে। যেমন, যদি বিপক্ষ বিনামূল্যে বড়ো ঘুটি খেতে দেয় তাহলে তা খাবার জন্য একটা ঘুটি দুবার চালা যেতে পারে। তার কারন একটা ঘুটি খাবার জন্য সময় নষ্ট হলেও তার পরিবর্তে আপনি যে বড়ো ঘুটি পাচ্ছেন সাধারণত তার মূল্য একটা চালের পিছনে নষ্ট সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। অনেক সময় আপনার কোনো বড়ো ঘুটি আক্রান্ত হলে সেই আক্রমণ সামলাতে আপনাকে একটা বাড়তি চাল নষ্ট করতে হতে পারে।

ইউটিউব ভিডিও লিঙ্কঃ

বিকল্প লিঙ্কঃ

lesson9.2.opening principles continued from Pingo Penguin on Vimeo.

 

৫/ খেলার একদম শুরুতে মন্ত্রী বাইরে আনবেন না

মন্ত্রী সবচেয়ে শক্তিশালী, তাই অন্য কোনো ঘুটির বদলে মন্ত্রী খাওয়া গেলে সেটা লোকসান। একদম শুরুতেই বড় ঘুটি যেমন মন্ত্রী বাইরে আনা খারাপ। এতে বিপক্ষ বাইরে আসা মন্ত্রী কে বারবার আক্রমণ করে নিজের ঘুটি কে বাইরে বার করবে, আর ছোটো ঘুটির হাতে মারা যাওয়ার ভয়ে মন্ত্রী সারা বোর্ড জুড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে জেতে বাধ্য হবে। অনেক সময় অনেক ছোটো ঘুটির মধ্যে মন্ত্রী বন্দি হয়েও যেতে পারে। তাই মন্ত্রীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আপনি বার বার মন্ত্রী চালতে বাধ্য হবেন। ফলে অনান্য ঘুটি চালবার সময় পাবেন না। এবং অনান্য ঘুটির বিকাশে পিছিয়ে পড়বেন। এই সমস্ত কারনে খেলার শুরুতেই মন্ত্রী বাইরে আনা প্রথম চারটে নিয়মের বিপক্ষে যায়। সুতরাং মন্ত্রীর চালের বদলে অনান্য ঘুটির চালের পিছনে সময় ব্যয় করা উচিত। অনান্য সমস্ত ঘুটি বাইরে আনা হয়ে গেলে খেলার পরিস্থিতি বুঝে কোন নিরাপদ জায়গা দেখে মন্ত্রীর চাল দেওয়া উচিত, যাতে মন্ত্রী সহজেই আক্রান্ত না হয়।

ঠিক একই রকম কারনে খেলার শুরুতেই নৌকা বাইরে আনা উচিত নয়।

ইউটিউব লিঙ্কঃ

বিকল্প লিঙ্কঃ

lesson9.3.dont bring your queen out too early from Pingo Penguin on Vimeo.

 

৬/ মাঝমাঠ দখল করুন

আমরা এখনও অবধি ঘুটির বিকাশের গুরুত্ব সম্বন্ধে জেনেছি। এবার ঘুটির বিকাশ কোথায় কিভাবে করবো সেই নিয়ে একটু আলোচনা করবো।

একটা বোর্ডে মোট ৬৪ টা ঘর থাকে। এই ৬৪ টা ঘরের প্রত্যেকটি সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়, বোর্ডের মাঝের ঘর বোর্ডের প্রান্তের বা কোনার ঘরের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা ফুটবল খেলার কথা ভাবুন। একটা দলের খেলোয়াড়রা মাঠের একদম প্রান্তে থেকে খেলার চেষ্টা করছে, আর অন্য দলের খেলোয়াড়রা মাঠের একদম মধ্যিখানে থেকে খেলছে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় দলের জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারন মাঝমাঠ দখলে থাকার ফলে দ্বিতীয় দলের খেলার প্রতি নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকবে। দাবা খেলাও একই রকম। মাঝমাঠের দখল যার থাকে খেলার রাশ তার হাতে থাকে। তাই খেলার একদম শুরুতে সমস্ত ঘুটির দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে মাঝমাঠ দখল বা নিয়ন্ত্রনের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। দাবা বোর্ডের মাঝমাঠ বলতে d4,e4,d5,e5 এই চারটে ঘর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই যে কোন ভালো ওপেনিং এ এই চারটে ঘরের দখলের চেষ্টার মাধ্যমে খেলা শুরু হয়। খেলার শুরুতে ঘোড়ার চালের জন্য সাধারণত c3 or f3 ঘর a3 or h3 এর চেয়ে অনেক ভালো, কারন প্রথম ক্ষেত্রে ঘোড়ার বিকাশ কেন্দ্রের দিকে হয়েছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রান্তে হয়েছে। আমরা পরের লেকচারে উদাহরণ সমেত এই ব্যাপারটা আরো ভালো করে জানবো। নিচে একটা ছবি দিলাম।

সাদা কেন্দ্রের দিকে ঘুটি বিকাশ করেছে, কালো প্রান্তে। সাদার পজশন অনেক ভালো।

 

মাঝমাঠ দখলের সবচেয়ে স্বাভাবিক উপায় হলো বোড়ে দিয়ে ঘর দখল করা। তাহলে এই নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রথম চাল টা সবচেয়ে ভালো? উত্তরঃ 1.e4 বা 1.d4. এর বদলে 1.h4 বা 1.a4 চাল দেওয়া হলে বোর্ডের কেন্দ্র বা মাঝমাঠ দখল করা হয় না, তাই এই চালগুলো ভালো নয়।
খেলার শুরুর দিকে খুব বেশি বোড়ের চাল দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। বোড়ে একবার সামনে এগিয়ে গেলে আর কখনও পিছনে আস্তে পারে না। তাছাড়া একা বোড়ে সামনে এগিয়ে গেলে বিপক্ষ সময় বুঝে একা এগিয়ে যাওয়া বোড়ে কে সহজেই আক্রমণ করবে। এতে বিপক্ষের সুবিধা। প্রথম প্রথম খেলা শিখলে খেলার শুরুতে শুধুমাত্র রাজা এবং মন্ত্রীর সামনের বোড়ে দুটো চালুন। অকারনে আর কোনো বোড়ে চাল দেওয়ার দরকার নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে, দুটো হাতি বাইরে আনতে সর্ব্বনিম্ন যে পরিমাণ বোড়ের চাল দরকার শুরুতে তার বেশি বোড়ের চাল দেওয়া ভাও নয়। ্তবে সহজে মাঝমাঠের দখল ছেড়ে দেওয়া ভালো নয়, তাই আপনার মাঝমাঠের বোড়ে আক্রান্ত হলে মাঝমাঠে বোড়ের দখল টিকিয়ে রাখতে বোড়ের চালের বিশেষ প্রয়োজন হলে কেবলমাত্র তবেই অন্য বোড়ে চালা যেতে পারে। বা প্রতিপক্ষের মাঝমাঠের দখল খুব ভালো হলে সেই দখলে ভাগ বসাবার জন্য কেন্দ্রের বোড়ে কে আক্রমণ করতে অনেক সময় বোড়ের চাল দেওয়ার দরকার হয়। এই ধরনের চালকে বলা হয় break move. তবে এই ধরণের বোড়ের চালের আগে সাধারণত প্রস্তুতি দরকার হয়। সমস্ত ঘুটির যথেষ্ঠ ভালো বিকাশ সমাপ্ত হলে তবেই break move  খেলা উচিত। এই ধরনের চাল সম্বন্ধে আমরা পরে আরও শিখবো।

৭/ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাসল করে রাজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করুন।

খেলায় রাজার নিরাপত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারন রাজা কে কিস্তিমাত করা সম্ভব হলে খেলা সমাপ্ত হয়। বোর্ডের মধ্যভাগে রাজা সবচেয়ে নিরাপদ নয়, তাই সাধারণত খেলার শুরুতে কাসলিং এর মাধ্যমে রাজা কে কোনো এক প্রান্তে রাখা হয়। কাসলিং এর বাড়তি সুবিধা হলো এতে মাত্র একটা চাল ব্যয় হয়, এবং কাসলিং এর ফলে নৌকার  মধ্যে সহজে সংযোগ স্থাপন হয় এবং নৌকা সহজে খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
৭ থেকে ১০ চাল এর মধ্যে কাসলিং এর চেষ্টা করুন। রাজার দিকে কাসল করতে কম সময় লাগে, তাই সাধারনত রাজার দিকে কাসল করা ভালো। রাজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সাধারণত রাজার সামনের বোড়ে অকারনে চালা উচিৎ নয়। কারন বোড়ে রাজাকে বিপক্ষের আক্রমণের হাত থেকে নিরাপত্তা প্রদান করে।

৮/ দুই নৌকার মধ্যে সংযোগস্থাপন করুন ( connect the rooks)

খেলার শুরুর ভাগ সঠিকভাবে পরিচালনা করলে একটা সময়ে কাসলিং এর পর (৭-১০চাল) দুই নৌকার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ তৈরী হবে। ঘুটির ডেভেলপমেন্ট এর মাঝপথে সবকিছু ভুলে হঠাৎ আক্রমণ করতে যাবার আগে আপনার দুই নৌকার মধ্যে সংযোগস্থাপন হয়েছে কি না খেয়াল করুন। সংযোগ তৈরী না হলে সতর্ক থাকুন, কারন আপনি ওপেনিং ঠিকভাবে পরিচালনা করেননি। অপরপক্ষে দুই নৌকার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে মানে আপনি খেলার শুরুর ভাগ ঠিকভাবে সব নিয়ম মেনে পরিচালনা করেছেন এবং ডেভেলপমেন্ট সম্পুর্ণ করেছেন। অর্থাৎ আপনি ১/সমস্ত ঘুটি বাইরে নিয়ে এসেছেন ২/কেন্দ্রের দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং ৩/কাসলিং এর মাধ্যমে রাজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছেন। সুতরাং দুই নৌকার মধ্যে যোগাযোগ তৈরী হলে ওপেনিং সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে বলা চলে।

৯/ পরিকল্পনা মাফিক খেলুন এবং প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা বোঝার চেষ্টা ও প্রতিহত করার চেষ্টা করুন।

আশা করি এতক্ষণে আমরা ওপেনিং এর সবচেয়ে প্রাথমিক ব্যাপারগুলো শিখে নিয়েছি। এবার আমরা একধাপ উপরে উঠবো।  সেনাবাহিনী বাইরে আনার সময় একটা পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সেই পরিকল্পনা মাফিক খেলা কে এগিয়ে নিয়ে যান। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা বোঝার চেষ্টা করুন এবং সাধ্যমত সেই পরিকল্পনা প্রতিহত করার চেষ্টা করুন। সমস্ত ঘুটিকে বিক্ষিপ্তভাবে বাইরে আনার চেয়ে একটা দূরদৃষ্টির কথা মাথায় রেখে সেই পরিকল্পনামাফিক সমস্ত ঘুটিকে বাইরে আনা ভালো। এমনভাবে খেলুন যাতে সমস্ত ঘুটি একসাথে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে, একে অন্যের পথে বাধা হয়ে না ওঠে। এরকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা খুব একটা সহজ নয়, তাছাড়া প্রতিপক্ষ প্রত্যেক মুহুর্তে সেই পরিকল্পনায় বাধা দেবার চেষ্টা করবে। সুতরাং আপনার একটা পরিকল্পনায় আটকে থাকলে চলবে না। একটা পরিকল্পনা কাজ না করলে দ্বিতীয় বিকল্প পরিকল্পনার তৈরী করে খেলা এগিয়ে নিয়ে চলুন।
সবচেয়ে খারাপ হলো কোন পরিকল্পনা ছাড়া কোন এক চালের একটা আক্রমণ তৈরী করে আশা করা প্রতিপক্ষ আক্রমণ দেখতে পাবে না। এরকম আশামূলক দাবা (hope chess) খেললে আপনার খেলার খুব একটা উন্নতি হবে না এটা গ্যারান্টি দেওয়া যায়। তাই hope chess খেলা বাদ দিয়ে প্রতিপক্ষকে সম্মান দিয়ে খেলুন। মনে রাখুন, আপনার এক চালের আক্রমণের উত্তর হিসাবে প্রতিপক্ষ ও একটা চাল পাবে রক্ষণ বা প্রতি আক্রমণের জন্য, সুতরাং সে নিশ্চয় আপনার আক্রমণ এর প্রতি নজর রাখবে। এককথায়, কোন পরিকল্পনা ছাড়া যে কোন জায়গায় আক্রমণ করলে সফল হবার সম্ভাবনা কম। প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য রক্ষণাত্মক চাল মাথায় রেখে পরিকল্পনা করুন, এবং এমনভাবে আক্রমণ করুন যাথে রক্ষণ খুব একটা সহজ না হয়। বা, প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গা খুঁজে বার করে সমস্ত শক্তি নিয়ে দুর্বল জায়গায় আক্রমণ করা উচিত, কারন দুর্বল জায়গা কে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। অবশ্য নিজের ও প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গা বোঝার জন্য খেলা সংক্রান্ত জ্ঞ্যান অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অনেক কাজে লাগে। তবে সবচেয়ে দরকারী বিষয় হলো যুক্তিযুক্ত ভাবনা (logical thinking)। অনেক সময় আপনার বিচার বিবেচনা সফল হবে না, তবে দাবা খুব জটিল খেলা, তাই অনেক বড়ো বড়ো খেলোয়াড়রাও অনেক সময় বিচার বিবেচনায় ভুল করেন, তাই ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক দিন ধরে খেললে কোন ধরনের ভাবনা সফল হতে পারে আর কোন ধরনের ভাবনার সফল হবার সম্ভাবনা কম সেই সম্বন্ধে আপনার ধারনা হবে। তাই সময়ের সাথে সাথে আপনি আরও ভালো পরিকল্পনা বানাতে সফল হবেন।
যাকগে, সাধারণ পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কথা বললাম। এবার কিছু দরকারী তথ্য দেওয়া যাক। আপনি যখন আপনার ঘুটির বিকাশ করবেন তখন সাধারণ বিকাশের সাথে অন্য কিছু করার চেষ্টা করুন। যেমন ঘোড়া বাইরের দিকে আনার সময় প্রতিপক্ষএর কেন্দ্রের বোড়ে কে আক্রমণ করার চেষ্টা করুন। গজ বাইরে আনার সময় প্রতিপক্ষের ঘোড়া কে একটা জায়গায় আটকে রাখার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে বাইরে আনুন। নৌকা সাধারণত মুক্ত ফাইল বরাবর ভালো কাজ করে। আপনার দুই নৌকার দ্বারা মুক্ত ফাইল দখল করার চেষ্টা করুন। মন্ত্রী কে খুব তাড়াতাড়ি বাইরে না এনে সমস্ত ঘুটিকে পিছন থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা মাথায় রেখে চালুন, ইত্যাদি।

প্রত্যেকটা টুর্নামেন্ট ওপেনিং বা বহুল প্রচলিত ওপেনিং এর পিছনেই একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকে। পরের লেকচারে আমরা দু একটা ওপেনিং উদাহরণ হিসাবে দেখবো।

১০/ বোড়ের চাল সম্বন্ধে সতর্ক হোন, এবং আপনার বোড়ের গঠনের অভিমুখে আক্রমণ করার চেষ্টা করুন

বোর্ডে সমস্ত ঘুটির মধ্যে বোড়ে একমাত্র ঘুটি যে শুধুমাত্র সামনের দিকে চলতে পারে, এবং সামনে বাধা থাকলে আর এগোতে পারে না। বোড়ের চাল কখনো ফেরত নেওয়া যায় না, তাই কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়া বোড়ে এগিয়ে নিয়ে গেলে বোড়ের আশেপাশের বা পিছনের ঘর গুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এরকম দুর্বল হয়ে যাওয়া ঘরকে ইংরিজিতে বলে weak squares. এককথায় দুর্বল ঘরের ডেফিনিশন দিতে গেলে বলতে হয়, দুর্বল ঘর মানে এমন ঘর যে ঘর কে কোন বোড়ের সাহাজ্যে রক্ষা করা যায়না। খেয়াল রাখুন যাতে আপনার পজিশনে খুব বেশি দুর্বল ঘর না থাকে, এবং আপনার প্রতিপক্ষের পজিশনে দুর্বল ঘর থাকলে সেসব দুর্বল ঘরগুলো আপনি আক্রমনের জন্য ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। পজিশনাল দাবা (positional chess) বোঝার জন্য বোড়ের চাল, বোড়ের গঠন এবং দুর্বল ঘর সম্বন্ধে ধারণা থাকা খুব জরুরি।

আপনার পজিশনে বোড়ের গঠন আপনার শরীরের হাড় এর গঠনের মতো। একবার একটা গঠন তৈরী হয়ে গেলে তা আর সহজে পরিবর্তন করা যায় না।  অন্য ঘুটির একটা চাল একটা বাজে ঘরে দেওয়া হলে একটা চাল নষ্টের মাধ্যমে পরে তা সংশোধন করার সুযোগ থাকে, কিন্তু বোড়ের চাল সংশোধনের কোন সুযোগ নেই। তাই বোড়ের গঠন তৈরীর সময় খুব সতর্কভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা মাথায় রেখে চাল দেওয়া উচিত। এবং আপনার বাকি সমস্ত ঘুটির চাল এবং খেলার গতিপথ এবং পরিকল্পনা ঠিক করার সময় বোড়ের গঠন মাথায় রেখে ঠিক করা উচিত।

আপনার শরীরের কোন জয়েন্ট যেই দিকে বাকানো সম্ভব তার উলটো দিকে বাকানোর চেষ্টা করে দেখুন, জয়েন্ট ভেঙে যাবে। দাবার পজিশনের ক্ষেত্রেও এরকম যুক্তি খাটে। বোড়ের গঠনের উলটো পথে আক্রমণ করার চেষ্টা করলে আপনার পজিশন কয়েক চালের মধ্যেই একদম ভেঙে পড়বে। সাধারণত বোড়ের চেইন লকড হয়ে গেলে চেইনের গতিপথের অভিমুখে আক্রমণের চেষ্টা করা উচিত, এবং প্রতিপক্ষের গঠন দুর্বল করার জন্য চেইনের ভিত (base) এ আক্রমণ করার উচিত। আর আপনার চেইনের ভিত শক্ত রাখার চেষ্টা করুন, যাতে প্রতিপক্ষ সহজে চেইনের গঠন ভাঙতে আন পারে। সমস্ত ঘুটির অবস্থান এমনভাবে রাখুন যাতে সমস্ত ঘুটি মিলে আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌছতে সাহায্য করে।

ওপেনিং বা প্রারম্ভিক ভাগের খুব সহজ নিয়মাবলী এই পর্যন্তই। এরপর আমরা বেশ কিছু উদাহরণের মাধ্যমে নিয়মগুলো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করবো।

 

 

 

Comments

comments

About the author

রাজীব মন্ডল

আমি একজন রসায়নের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট, কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে স্নাতক ও কানপুর আই আই টি থেকে স্নাতকোত্তর পাঠক্রম শেষ করার পর বর্তমানে মার্কিন মুলুকে জৈব রসায়ন নিয়ে গবেষণারত। দাবা নিয়ে উৎসাহী। উতসাহবশত অনেক পড়াশুনা করেছি। স্কুল কলেজ জীবনে এক আধটা টুর্নামেন্ট খেলেছি, তবে সেগুলোকে খুব সিরিয়াস টুর্নামেন্ট বলে চলে না। তার বাইরে খেলা বলতে ইন্টারনেটে নিয়মিত খেলি এবং তার বাইরে চর্চা ও করি। তবে ইন্টারনেটের বাইরে খুব একটা খেলিনা, বা কোনো খেতাব নেই। পুরোটাই স্ব-শিক্ষা, কোনোদিন অন্য কারো কাছ থেকে তালিম নিইনি, তবে খেলা শেখার পথে বহু লোকের লেখা পড়েছি, যাদের কে আমার শিক্ষক বলা চলে, কারন তাদের ছাড়া খেলা শেখা আমার পক্ষে সম্ভবপর হতো না।

Leave a Reply